পয়েন্ট সমূহ
(লোড হচ্ছে...)
Image by Free-Photos from Pixabay |
ভূমিকা:
ঋতুরঙ্গময়ী রূপসী বাংলা, বঙ্গ প্রকৃতির ঋতুরঙ্গে তার কী ছন্দময় , সংগীতময়, অনুরূপ রূপবদল! ঋতু পরিবর্তনের বর্ণবিচিত্র ধারাপথে নিয়ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠে তার অন্তহীন রূপের খেলা। অনুপম বৈচিত্র্যময় ঋতুরঙ্গের এমন উজ্জ্বল প্রকাশ বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও নেই। তাইতো কবিগুরু লিখেছেন-
"ওমা ফাগুণে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে কী দেখেছি মধুর হাসি।"
ঋতুচক্রের আবর্তন:
বাংলাদেশের ঋতু পরিবর্তনের মূলে রয়েছে জলবায়ুর প্রভাব ও ভৌগলিক অবস্থান। উত্তরে হিমালয়, দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর, মৌসুমি বায়ু এদেশের ঋতু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। এসব কারণেই এদেশে বারো মাসে ছয়টি ঋতু চক্রাকারে আবর্তিত হয়।ঋতুভেদে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য:
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার ঋতুবৈচিত্রের মধ্যে চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রতিটি ঋতু তার অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগমণ করে এবং নিজের অনাবিল সৌন্দর্য উপহার দিয়ে বিদায় নেয়। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহের তারতম্যে ঋতুগুলো একটি অপরটি থেকে আলাদা।ঋতুচক্রে বাংলাদেশ বনাম অন্য দেশ:
পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র ষড়ঋতুর দেশ। বারো মাসে ছয়টি ঋতু তাদের আলাদা আলাদা রূপ নিয়ে হাজির হওয়া এই পৃথিবীতে বিরল। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই দুইটি বা তিনটি করে ঋতু দেখা যায়। তবে কোনো কোনো দেশে চারটি ঋতুও দেখা যায়।বাংলাদেশের ঋতুভেদ:
বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। রূপসী বাংলার ছয়টি ঋতু যেন তার ছয়টি সন্তান। দুই মাস মিলে একটি ঋতু। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মিলে গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ মিলে বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন মিলে শরৎকাল, কার্তিক-অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ মিলে শীতকাল এবং ফাল্গুন-চৈত্র মিলে বসন্তকাল।মৌনী-তাপস গ্রীষ্ম:
বঙ্গ প্রকৃতির ঋতু রঙ্গশালায় প্রথম ঋতুনায়ক গ্রীষ্মকাল। বর্ষচক্রের প্রথম দৃশ্যেই ক্রুব্ধ দুইচোখে প্রখর বহ্নিজ্বালা নিয়ে আবির্ভাব ঘটে এই মহাতাপসের। নির্দয় নিদাম সূর্য কঠিন হাতে ছুড়ে মারে তার নিদারুন খড়তপ্ত অগ্নির্বাণ। প্রখর তাপদাহে ধরিত্রীর বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যায়। চৌচির হয়ে যায় তার তৃষ্ণার্ত প্রান্তর। কবিগুরু লিখেছেন-
"ঘাম ঝরে দরদর গ্রীষ্মের দুপুরে,
মাঠ-ঘাট চৌচির জল নেই পুকুরে।"
গ্রীষ্মের প্রকৃতি:
গ্রীষ্মের মরু রসনায় ধরিত্রীর প্রাণ শোষিত হয়ে কল্পিত শিখা উঠতে থাকে মহাশুণ্যে। এই দারুণ জ্বালায় স্তব্ধ করে দেয় সকল পাখপাখালিকে, জীব-জানোয়ারকে। সর্বত্রই এক ধূ ধূ মরুভূমি। সবকিছু হয়ে যায় নির্জীব, প্রাণহীন, রসহীন। মাঝে মাঝে কালবৈশাখী গ্রাস করে প্রকৃতিকে।গ্রীষ্মের ফুলফল:
গ্রীষ্ম ঋতু কোনো ফুলের ঋতু নয়। তাই ফুল ফোটাবার কোনো তাড়া নেই তার। শুধু ফলের ডালা সাজিয়েই নিঃশব্দে বিদায় নেয় সে। আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, তরমুজ, আমড়া এই ঋতুতে জন্মে। বকুল, টগর, জবা এই ঋতুর ফল।সজল বর্ষা:
বর্ষা বাংলা বর্ষের দ্বিতীয় ঋতু। এই ঋতুতে আবহাওয়া সবসময় ঠান্ডা থাকে। কবিগুরু লিখেছেন-
"আমি বর্ষা, আসিলাম গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি
মায়ার কাজল চোখে, মমতায় বর্মপুট ভরি।"
পিপাসার্ত বাংলাদেশকে বর্ষাকালের হাতে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তুলে দিয়ে বিদায় নেয় গ্রীষ্মকাল। দূর-দিগন্তে ধূসর আকাশের বুকে স্তরে স্তরে জমে উঠে নবীন কালো মেঘের স্তুপ। ধরণীর বুকে নেমে আসে বৃষ্টি।
বর্ষার প্রকৃতি:
"এদিক দিগন্তে যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল,
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।"
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।"
বর্ষার আকাশ কালো মেঘে ঢাকা থাকে। শুরু হয় বজ্রপাতের সাথে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত। নদীনালা, খালবিল পানিতে ভরে যায়। প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয়। সবকিছু সবুজ শ্যামল হয়ে উঠে।
বর্ষার ফুলফল:
বর্ষায় তেমন কোনো ফল পাওয়া না গেলেও বর্ষায় নানান রকমের ফুল পাওয়া যায়। বর্ষার ফুলগুলো হলো কেয়া, কদম, কামিনী, জুঁই, শিউলি ইত্যাদি। বর্ষায় আনারস, শশা, পেয়ারাসহ নানান রকমের ফল পাওয়া যায়। কবিগুরু বলেন-
"গুরুগুরু ডাকে দেয়া,
ফুটিছে কদম কেয়া।"
শুভ্র শরৎ:
"আজি ধানের ক্ষেত্রে রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরি খেলা
নীল -আকাশে কে ভাসালো সাদা মেঘের ভেলা।"
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীল -আকাশে কে ভাসালো সাদা মেঘের ভেলা।"
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বর্ষার অবসানে তৃতীয় ঋতু শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে আবির্ভূত হয়। শরৎকে বলা হয় 'ঋতুরাণী'। বর্ষণ-ধৌত, মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপ-কান্তি আলোচ্ছায়ায় শরৎ আগমণ করে।
শরৎকালের প্রকৃতি:
শরৎকালের প্রকৃতি থাকে নির্মল ও স্বচ্ছ। আকাশে সাদা মেঘ ঘুরে বেড়ায়। রাতের মেঘমুক্ত আকাশে থাকে অজস্র তারা। শিউলি ফুলের গন্ধে চারিদিক ভরে উঠে। বিলে-ঝিলে ফোটে শাপলা আর নদীতীরে কাশফুল। গাছে পাকে তাল। তাই কবির উচ্চারণ-
"আজিকে তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারৎ প্রভাতে।"
ধূসর হেমন্ত:
হেমন্ত শরতেরই বিলম্বিত রূপ। বঙ্গ ঋতুনাট্যের সে চতুর্থ শিল্পী। সে উদাসীন, পৌঢ় এবং বিষণ্ণ। রূপসী হেমন্ত ধূসর কুয়াশায় নয়ন ঢেকে ফসল ফলাবার নিঃসঙ্গ সাধণায় থাকে নিমগ্ন। হেমন্ত শীতের আগাম বার্তা নিয়ে আসে। ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবের ধুম পড়ে। ‘তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই গেয়েছেন-‘ওমা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।’
উদাসী শীত:
শীত ঋতুচক্রের পঞ্চম ঋতু। শীতকাল সাধারণত শুষ্ক ঋতু। এটি সবচেয়ে সুন্দর ও আরামদায়ক ঋতু। এসময় হিমালয় থেকে উত্তুরে বাতাস দেশে প্রবেশ করে। তাই দেশের উপর দিয়ে শৈতপ্রবাহ বয়ে যায়। এসময় গরিবেরা শীতের প্রকোপে অনেক কষ্ট করে থাকে। তারা খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন তৈরি করে নিজেদের গরম রাখার চেষ্টা করে। অন্যদিকে বড়লোকের ঘরে তখন থাকে উৎসবের আমেজ। পিঠাপুলির আনন্দে সকলে থাকে আত্মহারা। কবি বলেছেন-"এলো যে শীতের বেলা বরষ-পরে,
এবারে ফসল কেটে নাওগো ঘরে।"
শীতের প্রকৃতি:
শীতকালে প্রকৃতি শুষ্ক ও ম্লান থাকে। চারিদিকে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। উত্তর দিক থেকে আসতে থাকে হিমালয়ের ঠান্ডা বাতাস। এসময় দিন ছোট হয় এবং রাত বড় হয়। গাছপালার পাতা, লতা শুকিয়ে যেতে থাকে। বৃষ্টির অভাবে নদীর পানিও অনেকটা কমে যায়। ভোরবেলা কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় চারপাশ। অনেক কাছের জিনিসও তখন স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় না। এইসময় অন্যান্য দেশ থেকে আমাদের দেশে আসে অনেক নাম না জানা অতিথি পাখি। নতুন নতুন শাক-সবজির আনাগোনায় জমিগুলো ভরে যায়।শীতের ফুল ও ফল:
শীতকাল নানা ধরণের শাকসবজির কারণে খুবই সমাদৃত। এসময়ের ফল হলো বরই আর কমলালেবু। এসময় নতুন নতুন শাকসবজিতে হাট-বাজার, প্রকৃতি পরিপূর্ণ থাকে। খেজুড়ের গুড় ও রসের গন্ধে চারিদিক মো মো করে। এসময় গাদা, সূর্যমুখী, ডালিয়াসহ নানান ধরণের ফুল ফুটে থাকে।কবি গুরু তাই শীতকে নিয়েও কবিতা লিখতে ভোলেননি-
‘শীতের হাওয়া লাগল আজি
আমলকির ঐ ডালে ডালে।’
আমলকির ঐ ডালে ডালে।’
ঋতুরাজ বসন্ত:
বসন্ত ঋতুচক্রের সর্বশেষ ঋতু। মাঘের সূর্য উত্তরায়নে পাশ হয়ে চলে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। বসন্ত আসে পুষ্পরাত্রির পরম লগ্নে, মৃদুমন্দ দক্ষিণা বাতাসের জাদুস্পর্শে। বর্ণ বিরল পৃথিবীর সর্বত্র লাগে অপূর্ব পুলক প্রবাহ। বসন্তের মোহমায়তায় মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন-‘আহা! আজি এ বসন্তে-
কতফুল ফোটে, কত বাঁশি বাজে, কত পাখি গায়’।
বসন্তের প্রকৃতি:
বসন্তে বনবিথীর রিক্ত শাখায় জাগে কচি কচি কিশলয়ের অফুরন্ত উল্লাস। দূর-দূরান্ত থেকে ভেসে আসে কোকিলের কুহুতান। অশোক, শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, মধুমালতী ও মাধবী মঞ্জরীর গন্ধ লাগে সারা গগনতলে। কবিগুরু লিখেছেন-
"মহুয়ার মালা গলে কে তুমি এলে,
নয়ন ভুলানো রূপে কে তুমি এলে।"
মানব মনে ষড়ঋতুর প্রভাব:
মানবমনে ঋতুচক্রের প্রভাব অপরিসীম। গ্রীষ্মে মানবমন থাকে ক্লান্ত, অবসন্ন। মানবমনে সর্বদাই অস্থিরতা বিরাজ করে তাপদাহের কারণে। বর্ষার আগমণ মানবমনকে করে শান্ত, স্নিগ্ধ। মানবমনে লাগে বৃষ্টির দোলা। বাদলের দিনে কবিমন নতুন গান রচনা করেন। শরৎ এর রূপ দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। প্রবল বর্ষণ থেকে রেহাই পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে। হেমন্তে সকলে ভাসে ফসলের আনন্দে। শীতকালের রুক্ষতা মানুষকে গ্রাস করলেও শীতের পিঠাপুলি মানুষের মনকে করে পুলকিত। আর বসন্তের স্নিগ্ধ হাওয়া, ফুলের সুবাস মানুষের মনকে করে তুলে আরও উদার। তাই বাংলার মানুষ এতটা সহজ সরল।উপসংহার:
সত্যিই অনবদ্য সৌন্দর্যে ভরা বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য। কিন্তু কালের বিবর্তনে বাংলার সেই আগের রূপ দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে।যান্ত্রিক সভ্যতা ক্রমেই এগিয়ে চলেছে যা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আশঙ্কাজনক। শুধু জননী জন্মভূমির রূপেই নয়, রূপসি বাংলার এই ষড়ঋতু নানা বর্ণ, গন্ধ, রঙের সমারোহে নিত্য আবর্তিত হয়। প্রকৃতির এমন রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তাইতো জীবনানন্দ দাশ গেয়েছেন-
"বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি
তাই আমি পৃথিবীর রূপ দেখিতে চাই না আর।"