পয়েন্ট সমূহ
(লোড হচ্ছে...)
Image by Nazrul Institute |
ভূমিকা:
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। সকলের নিকট তিনি বিদ্রোহী কবি নামে পরিচিত। তিনি বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও সংগীতজ্ঞ। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সবসময় সোচ্চার। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি ও বিদ্রোহ। বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ জুড়ে নজরুলের সাহিত্যকর্ম বিদ্যমান। তার সুন্দর সুন্দর কবিতায় ছোটদের ছেলেবেলা যেমন হয়েছে প্রাণচঞ্চল তেমনি তার গানে ও ছন্দে তরূণদের রক্ত হয়েছে গরম ও অন্যায়ের জন্য সোচ্চার হয়েছে মানুষ। আর সেই কাজী নজরুলই আমার প্রিয় কবি।নজরুলের জন্ম:
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতা জাহেদা খাতুন। চার পুত্র সন্তানের মৃত্যুর পর নজরুল জন্মগ্রহণ করায় বাবা মা তার নাম রাখেন দুখু মিয়া। শৈশবেই তিনি তার পিতাকে হারান। পিতৃবিয়োগের ফলে তাদের সংসারে নেমে আসে অভাবের ছায়া। সেই সময় অভিভাবকহীন নজরুল হয়ে যান কিছুটা উছৃঙ্খল ও দিশেহারা স্বভাবের।
নজরুলের শৈশব:
নজরুলের শৈশবকাল ছিল বড়ই করুণ। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি তার পিতাকে হারান। পিতাকে হারানোর পর তার সংসারে আসে অভাবের ছায়া। তাই মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে পড়ালেখা বাদ দিয়ে উপার্জনের জন্য বাড়ির বাইরে বের হতে হয়। এলাকার মক্তব থেকে তিনি নিম্ন মাধ্যমিক পাশ করে সেই মক্তবেই শিক্ষকতা করা শুরু করেন। সেই সাথে সেই এলাকার হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং একটি মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজে নিযুক্ত হন তিনি। এইভাবে ছোটোবেলা থেকেই ইসলাম সম্বন্ধে অনেক জ্ঞান তিনি রপ্ত করেন যা তার পরবর্তী জীবনে সাহিত্যকর্মে সাহায্য করে। মূলত নজরুলই বাংলা সাহিত্যে ইসলামচর্চার কাজ শুরু করেন।লেটোর দলে নজরুল:
বাবা মারা যাবার পর তিনি মক্তবে ও মসজিদে কাজ করলেও সেই কাজে তার বেশিদিন মন বসে নি। বালক বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি ঝোকের কারণে এক লেটোর দলে তিনি যোগ দেন। তার এক চাচা ছিলেন চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলে ওস্তাদ। আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা তার দখলে ছিল। ধারণা করা হয় তার হাত ধরেই নজরুলের লেটোর দলে যাত্রা শুরু হয়। লেটোর প্রতিটি আসরে নজরুল বসতেন ও গান শুনতেন। মাঝে মধ্যে পাড়ায় বের হয়ে গান গাইতেন। মূলত লেটোর সেই দল থেকেই নজরুলের সাহিত্যচর্চা শুরু। পরবর্তী সময়ে লেটোর বিভিন্ন আসরের জন্য তিনি কবিতা, ছড়া, ছন্দ, গান ইত্যাদি লিখতেন ও লেটোর সেইসব আসরে গান, নাটক ইত্যাদিতে অংশ নিতেন।নজরুলের শিক্ষাজীবন:
আর্থিক সমস্যার কারণে নজরুল প্রথম থেকেই পড়ালেখার তেমন সুযোগ পাননি। মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর তিনি কাজে যোগ দেন। প্রথমে তিনি বাসুদেবের কবিদলের আসরে যোগ দেন। অতঃপর তার ঠাই হয় আসানসোলের একটি রুটির দোকানে। সেখানে আসানসোলের এক দারোগার সাথে তার পরিচয় হয়। রুটি ও চা বানানোর সময় নজরুলের বানানো ছড়া ও গান শুনে ঐ দারোগা নজরুলের প্রতিভার কথা জানতে পারেন। তিনি তাকে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখানে তিনি ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল স্কুলে ভর্তি হন এবং মাধ্যমিক পরীক্ষা না দিয়েই সৈনিক হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।নজরুলের সাংবাদিক জীবন:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে নজরুল দেশে ফিরে এসে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকা শুরু করেন। সেখান থেকেই তার বঙ্গদেশে সাহিত্যচর্চার শুরু। তার সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মূল কাজগুলো এখান থেকেই শুরু হয়। প্রথম থেকে মুসলিম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য, উপাসনা নামক বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা নিয়মিত ছাপা হতে থাকে। তার বিভিন্ন উপন্যাস যেমন তরনী, কোরবানি, মহররম ইত্যাদি অনেক প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে অনেক বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকগণের নজরে আসেন আমাদের কবি নজরুল। অনেক কবি সাহিত্যিকরা তার কবিতা ও উপন্যাসের প্রসংসা করে প্রবন্ধ লেখতে থাকেন। এভাবেই বাংলায় সাহিত্য অঙ্গনে নজরুল বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।নজরুলের সাহিত্যে পদার্পন:
বাংলার সাহিত্যে নজরুলের আগমণ হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। নজরুলের কাব্যিক প্রতিভা বরাবরের মতোই মানুষকে অবাক করতো। তিনি চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়স থেকেই কবিতা, গান, ছড়া লিখে মানুষের মন জয় করতে পেরেছিলেন। তিনি বিভিন্ন পালাগান লিখে তাতে সুরারোপ করেছিলেন।সংগীতে এরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া এতোটা পারদর্শী হওয়া বিরল। তার লেখা গানে ছিল অন্যরকম এক আবেশ যা শিশুদের যেমন আনন্দ দিত তেমনি তরুণদের দিত সাহস। তার বিদ্রোহী ও সাম্যের মনোভাবের কারণে পরবর্তীতে তিনি সাম্য ও বিদ্রোহের কবি নামে স্বীকৃতি লাভ করেন।জাগরণ ও যৌবনের কবি:
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ছিলেন জাগরণ ও যৌবনের কবি। তিনি দেশের ঘুমিয়ে থাকা তরুনদের জাগাতে চেয়েছিলেন। দেশের অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তিনি তরুণদের জেগে উঠে সেই অন্যায় পাপাচারে বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিলেন। তার কবিতা শুনলেই তরুণদের গায়ে কাটা দিয়ে উঠতো, রক্ত গরম হয়ে যেত। দেশের মাটিতে এসে যখন তিনি দেশকে অন্যায় পাপাচারে জর্জরিত দেখলেন তখনই তার মুখে বেজে উঠে বিদ্রোহের বাশি,
"কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষান বেদি।"
তার বিদ্রোহী কণ্ঠে আরো বেজে উঠে,
"আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস
আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ।"
তারুণ্যের কবি নজরুল:
কবি নজরুলের বেশিরভাগ কবিতা, গল্প ও গান ছিল তরুণদের জন্য। দেশের ঘুমিয়ে থাকা তরুণদের জাগিয়ে তোলার জন্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য তিনি দিয়েছিলেন সাম্যের বাণী। তার বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতা ও অন্যান্য কবিতায় রক্ত গরম করা সেই ছন্দগুলো পড়লেই বোঝা যায় তিনি কতটা সংগ্রামী মনোভাবের কবি ছিলেন। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে তরুণদেরকে এগিয়ে আসতে তিনি বারবার মুখ খুলেছেন। তাছাড়া নজরুল তার কবিতায় আর্ত-পীরিতদের কথাও বলেছেন। তাদের কষ্ট দুর্দশা নিয়ে লিখেছেন নানান কবিতা। তিনি তার কবিতায় বলেন,
"দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিন নিচে ফেলে
চোখ ফেটে এলো জল
এমনি করে কী জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?"
সাম্যের কবি নজরুল:
নজরুলের কবিতার একটি বিশেষ দিক হলো সাম্প্রদায়িকতা। তাই তাকে সাম্যের কবি বলা হয়। এই পৃথিবীতে সকল মানুষ কে তিনি এক জাতি অর্থাৎ ধনী-গরিব, ধলো-কালো ভুলে গিয়ে এক মানুষ জাতি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। এই সাম্যের জন্য তিনি অনেক কবিতা লিখে গিয়েছেন। তিনি তার কবিতায় বলেন,
"গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান"
তাছাড়া ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু-মুসলিম যে দাঙ্গা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে তিনি কলমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তার কলম থেকে বেরিয়ে আসে,
"হিন্দু না ওরা মুসলিম
ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন
কাণ্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ
সন্তান মোর মার"
স্বদেশের কবি নজরুল:
কবি কাজী নজরুল সাম্য ও বিদ্রোহের কবি হিসেবে বেশি পরিচিতি লাভ করলেও স্বদেশের জন্যও তিনি কম কবিতা লেখেননি। স্বদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি লিখেন,
"একি অপরূপ রুপে হেরিনু মা তোমায় পল্লী-জননী
ফুলে ফসলে, কাদামাটি জলে ঝলমল করে লাবণী"
স্বদেশের জন্য কবি নজরুল অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। স্বদেশের স্বাধীনতা ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে কবিতা লিখে মানুষদের সচেতন করার জন্য তাকে অনেকবার জেলে যেতে হয়েছে। তবু তার কলম থেমে থাকেনি। জেলে বসেই তিনি রচনা করেন আরও অনেক কবিতা। দেশের এতটুকু অসম্মানও তিনি কখনোও সহ্য করেননি। দেশের জন্য আত্মত্যাগে তিনি ছিলেন সর্বদা প্রস্তুত।
মানবতার কবি নজরুল:
নজরুল ছিলেন মানবতার কবি। তার চোখে নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ ছিল না। নারী-পুরুষের এই ভেদাভেদ আজকের দিনের অনেকে মানতে না চাইলেও সেই সময় থেকেই নজরুল তা বুঝতে পেরেছিলেন। নজরুল তার কবিতায় বলেন,
"সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যানকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর"
নজরুলের কারাবরন:
কবি নজরুল ছিলেন ইংরেজ আমলের কবি। ইংরেজদের শাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি অনেক কবিতা, গান রচনা করেছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য তাকে অনেকবার কারাগারে বন্দী থাকতে হয়। তবে কারাগারে গিয়েও তিনি ক্ষান্ত হননি। কারাগারে বসেই লিখতে থাকেন অগ্নীঝরা বিভিন্ন কবিতার লাইন। তার সেসব কবিতা শুনে লোম খাড়া হয়ে যেত, তরুণদের রক্ত হতো গরম। তিনি তার বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতায় লিখেন,
"আমি হলাম বলরাম স্কন্ধে
আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে!"